কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর ইতিহাস

গত শতাব্দীর শেষ দিকেও অভিভাবকরা তাদের শিশুদের গুরুত্বের সাথে মক্তবে পাঠাতেন। মক্তবের সেই জৌলুশ এখন আর নেই। মক্তব ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিলো বলে এই মাটির পরতে পরতে রয়েছে ইসলাম। সেই মক্তবের অবস্থা দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। এভাবে দুর্বল হতে থাকলে এক সময় মক্তব ব্যবস্থা হারিয়ে যেতে পারে।

বৃটিশ আগমনের আগে আমাদের দেশে মক্তব ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী ছিলো, আমাদের ছোটকালের মক্তবের চাইতে আরো বেশি শক্তিশালী ছিলো। বৃটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর আস্তে আস্তে মক্তবগুলো বন্ধ হতে থাকে। একটা পর্যায়ে বাংলার ৮০ হাজার মক্তব-মাদ্রাসা পুরোপুরী বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় অশিক্ষার আলো। আমাদের কয়েক পুরুষ আগের লোকজন কিন্তু শিক্ষিত ছিলেন, যদিও আমাদের সাম্প্রতিক আগের কয়েক জেনারেশন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

মক্তব ব্যবস্থা বিলুপ্তির পথে- এর প্রধান কারণ কী? আমরা অনেকেই মনে করতাম- কেজি স্কুল এবং স্কুল ব্যবস্থার প্রাধান্য। আসলে কি তাই? কেজি স্কুল বা মর্নিং স্কুল ব্যবস্থা একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু প্রধান কারণ নয়। তাহলে কী? বিশেষ করে কানাইঘাট উপজেলায় মক্তব ব্যবস্থা যে ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে- এর কারণ কী?

কারণগুলো চিহ্নিতকরণ ও সমাধান পথ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। ডাটা প্রয়োজন। তাই আমরা কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে হাতে নিয়েছি ’’কানাইঘাট উপজেলার মক্তব শিক্ষা: একটি সমীক্ষা’’- শীর্ষক গবেষণা প্রকল্প। ছয় মাস ব্যাপী এই গবেষণা সম্পাদনের পর গবেষণার ফাইন্ডিংস এর আলোকে আমরা আমাদের পরবর্তী কাজের রোডম্যাপ তৈরি করবো।

কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মহতি উদ্যোগের সাথে আপনিও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। আমাদের এই সংস্থার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়েছে ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে। কানাইঘাট উপজেলার সকল ইউনিয়ন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা কানাইঘাটিদের নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। ৭১ সদস্য কমটিতে রয়েছেন একজন চেয়ারম্যান, একজন কো-চেয়ারম্যান, একজন সেক্রেটারি এবং আরো বিভিন্ন পদ। কানাইঘাট উপজেলার দশটি প্রশাসনিক অঞ্চল (একটি পৌরসভা ও নয়টি ইউনিয়ন) থেকে একজন করে সহ-সভাপতি আছেন এই কমিটিতে। বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের ১৩টি দেশ থেকে কানাইঘাটি লোকজন কমিটিতে আছেন। নারী প্রতিনিধিত্বও রয়েছে।

সুলতানী ও মুঘলি আমলে মক্তব ব্যবস্থা খুবই শক্ত ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান ছিলো। মুসলিম শাসনামলে সুবেদার, সুলতান, নবাব নাজিমগণ মাদ্রাসা মক্তবের জন্য উদারহস্তে দান করতেন। নগদ অর্থের চেয়ে অনেক বেশি দান করতেন লাখেরাজ জমি। তখন করমুক্ত জমিকে লাখেরাজ জমি বলা হতো এবং লাখেরাজ সম্পত্তি মূলত ব্যয় করা হতো শিক্ষার কাজে। এই লাখেরাজ জমিই ছিলো ব্রিটিশ আগমনের আগে মুসলিম শাসনামলে বাংলায় মক্তব ও মাদ্রাসার আয়ের প্রধান উৎস।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী খাজনা আদায় করতে গিয়ে দেখলো যে, বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব-মাদ্রাসার জন্য মোট জমির চার ভাগের একভাগ লাখেরাজ বরাদ্দ দেওয়া। বিষয়টি ইংরেজদের ভাবিয়ে তুলে। তখনই আইন ও বিধি-বিধান করে এই লাখেরাজ জমি হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের ইজারা দিতে থাকে। এই সংক্রান্ত তিনটি আইন হলো- (১) ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন-১৯ (২) ১৮১৯ সালের রেগুলেশন-২; এবং (৩) রিজামসার ল’ অব ১৮২৮ (লাখেরাজ ভূমি অধিগ্রহন আইন)। ফলে মক্তব মাদ্রাসার আয় কমতে থাকে এবং বন্ধ হতে থাকে।

সুচতুর ব্রিটিশ রাজ সরাসরি কোন মক্তব-মাদ্রাসা বন্ধ করেনি, কিন্তু গভীর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করায় ৮০ হাজার মক্তব-মাদ্রাসা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় এবং মুসলিমরা অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। গণশিক্ষা ও মক্তব শিক্ষার উন্নয়নে ’কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ তার নিজ সামর্থ অনুযায়ী একটু গভীরে গিয়ে একটু সৃজনশীল কাজ করতে চায়। তাই ’’কানাইঘাট উপজেলার মক্তব শিক্ষা: একটি সমীক্ষা’’- শীর্ষক গবেষণা প্রকল্প প্রথমেই হাতে নেওয়া হয়েছে। ছয় মাস ব্যাপী এই গবেষণা সম্পাদনের পর গবেষণার ফাইন্ডিংস এর আলোকে কাজের পরবর্তী রোডম্যাপ তৈরি করা হবে।

এই গবেষণা শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। ডাটা কালেকশনের জন্য এ১০ জন (নয়টি ইউনিয়ন+একটি পৌরসভা) তথ্য-সংগ্রাহক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায় থেকে তথ্যগুলো আসার পর ডেস্ক রিভিউ এবং গবেষণার অন্যান্য মেথোডোলজি ব্যবহার করে এই গবেষণা সম্পাদন করা হবে।

তথ্য-সংগ্রাহকদের যাতায়াত ও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য টিএ/ডিএ এবং রিমিউনারে’শন প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গবেষণার ফাইন্ডিংশ প্রকাশ করা হবে। গবেষণার আলোকে এই বছরের শেষের দিকে একটি বই প্রকাশিত হবে। বইটি কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের একটি প্রকাশনা হিসেবে থাকবে।

কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কেন তার প্রথম কর্মসূচী হিসেবে গবেষণাকে হাতে নিলো? সৃজনশীল এবং পদ্ধতিগত কাজই হচ্ছে গবেষণা। গবেষণা বলতে বুঝায় পুনঃপুন অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিরাজমান সমস্যা নিরসনকল্পে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো বাস্তবিক কোনো সমস্যার সমাধান করা। মক্তব শিক্ষা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে– এ থেকে উত্তরণের জন্য গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন বাস্তবিক পদক্ষেপ নিতে চায়। আর এই জন্য গবেষণার বিকল্প নেই।

মক্তব সংক্রান্ত গবেষণায় মাঠ পর্যায় থেকে যেসব ডাটা উঠে আসবে–

  • কানাইঘাটে মক্তব কয়টি, কোন ইউনিয়ন, কোন ওয়ার্ড ও কোন গ্রামে কয়টি-
  • প্রতি মক্তবের শিক্ষক (ইমাম) ও মুতাওয়াল্লীর নাম ও ফোন নাম্বার
  • ইমামের বেতন-
  • মক্তবে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, শিক্ষার্থী ও মক্তব শিক্ষকের অনুপাত- * মক্তবের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কি আগ থেকে কমেছে, কমলে কারণ কী, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে ইমামের বা সংশ্লিষ্ঠদের অভিমত-
  • সংশ্লিষ্ঠ ইউনিয়নে মক্তব বন্ধ হয়েছে কয়টি, কেন বন্ধ হয়েছে, এগুলো চালু করা যায় কিভাবে–
  • মক্তবের জন্য পৃথক কোনো শিক্ষক আছেন কী–
  • শিক্ষার্থী অনুযায়ী শিক্ষকদের সংখ্যা উপযোগী নাকি অনুপযোগী–
  • মক্তবগুলো নিয়ে পৃথক কোন বোর্ড আছে কী– ইত্যাদি।

কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হওয়ার পর পরই গবেষণার কাজ শুরু হয়। কমিটি হয়েছে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট। প্রশ্ন জাগতে পারে- এটা তো ঢাউস কমিটি। প্রচলিত সংস্থা-সমিতিতে এত বড় কমিটি থাকেনা। আপনার মনে যদি এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়, যৌক্তিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমাদের সংস্থার অবয়ব, কাঠামো ও কর্মসূচীর সিস্টেম একটু ভিন্ন।

এটাই বোধ হয় কানাইঘাটের প্রথম সংস্থা, যেটা গঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কানাইঘাটি নিয়ে। কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কমিটিতে ফ্রান্স, সৌদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ওমান, কাতার, আমেরিকা-সহ বিশ্বের ১৩ টি দেশ থেকে প্রতিনিধি যুক্ত আছেন। অন্যদিকে, কানাইঘাটের ১০ টি এলাকা (নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা) থেকে প্রতিনিধি থাকছেন। ফলে কমিটির পরিসর একটু বড় হওয়া স্বাভাবিক, প্রয়োজন হলে ৭১ থেকে আরেকটু বড় হবে। সব দেশ ও সব অঞ্চল কভার দিতে হলে সব জায়গার প্রতিনিধি লাগবে। কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন হোক কানাইঘাট আপামর জনতার সংগঠন।

এহসানুল হক জসীম

চেয়ারম্যান

কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন