একাধারে ৫৯ বছর ইমামতি শেষে রাজকীয় বিদায়

বয়স ৯০। উচ্চারণে কিছুটা অস্পষ্টতা লক্ষণীয়। যৌবনের ভরা ভাদরে শুরু করেছিলেন ইমামতি। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নের পুর্ব সুপ্রাকান্দি জামে মসজিদে। বয়স ছিলো তখন ৩১। ইমামতির শুরুতে যাদেরকে পেয়েছিলেন মুসল্লী হিসেবে, তাদের বড় অংশটি এখন ঘাসের নিচে। মক্তবের শিক্ষার্থী হিসেবে যাদেরকে পেয়েছিলেন, তাদের সন্তানদেরও পড়িয়েছেন, সেই সন্তানদের সন্তানদেরও পড়িয়েছেন। কয়েক জেনারেশনের ইমাম ও মক্তবের উস্তাদ। 

 

বোধ হয়, রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ৫৯ বছর একাধারে একই মসজিদে ইমামতি করে রেকর্ড গড়েছেন। এতদিন ইমামতি করার রেকর্ড আমাদের জানাশুনার মধ্যে কারো নেই। ইমাম পাল্টানো যেখানে বহু মহল্লার মানুষের খাসলতে পরিণত হয়েছে, সেখানে সুপ্রকান্দির লোকজন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।  

 

সেদিন একজন খবর দিলো, স্থানীয়ভাবে বড় হুজুর নামে পরিচিত মাওলানা মাহমুদুর রহমান সুপ্রাকান্দি জামে মসজিদে একাধারে ৫৬ বছর ইমামতি করে বিদায় নিয়েছেন। গেলো ৪ মার্চ ২০২৪ তারিখে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। চমকপ্রদ তথ্য। বুঝতে বাকি রইলো না, এটা ইমামতির রেকর্ড। সংবর্ধনা প্রদানও গুরুত্ববহ। ৫৯ বছর একাধারে ইমামতির পাশাপাশি কয় ইমামের ভাগ্যে বিদায় সংবর্ধনা জুটে?

 

খোঁজ নিলাম। জানলাম, ৫৬ বছর নয়, প্রায় ৫৯ বছর ইমামতি করে বিদায় নিয়েছেন নিয়েছেন মাওলানা মাহমুদুর রহমান। সংবর্ধনার দিন নিজের বয়ানে বলেছেন, ১৩৭২ বাংলায় তিনি এই মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। ১৪৩০ বাংলা বিদায়ের দিকে। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৯৬৫ সালে শুরু, শেষ ২০২৪ সালে। প্রায় ৫৯ বছর। চাট্টিখানি কথা! মাওলানা মাহমুদুর রহমানের দীর্ঘদিনের এই ইমামতি করার বিষয়টি কেবলই রেকর্ড হিসেবে নয়; ইমামের প্রতি সম্মান এবং ইমামের চাকুরির নিশ্চয়তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও এ এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। ইমামের প্রতি এমন সম্মান ও চাকুরির নিশ্চয়তা সৃষ্টি হোক অন্যান্য মহল্লায়ও। 

 

জানা যায়, তরুণ বয়সে ১৯৬৫ সালে মাওলানা মাহমুদুর রহমান (বড় হুজুর) সুপ্রাকান্দি জামে মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েন আরো বছর কয়েক আগে। যে মসজিদ ইমাম সাহেবের মায়ার গেহ হয়ে গেছে, যেখানকার কয়েক জেনারেশনের ইমাম ও মক্তবের উস্তাদ তিনি, সেই মসজিদ ও মহল্লার মায়া তিনি কেমনে ছাড়বেন? আর গ্রামবাসী তাদের জন্মের আগ থেকে যাকে মসজিদের ইমাম হিসেবে দেখে আসছে, সেই বড় হুজুরকে কিভাবে বিদায় দেবে? কিন্তু শরীর যে আর কুলোয় না। এবার ইমামতি জীবনের ইতি টানতে যে হয়। জীবন সায়াহ্নে এসে ৯০ বছর বয়সে অবশেষে ইমামতি অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে তাঁর।

 

যে ইমাম গড়েছেন রেকর্ড, পুরো মহল্লার প্রায় সকল পুরুষ যার সরাসরি ছাত্র, সেই প্রিয় হুজুরের বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার। দলমত নির্বিশেষে গ্রামবাসী সংবর্ধনায় সমবেত হন। অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয় ইমামকে বিদায় জানান। 

 

সংবর্ধনা উপলক্ষে তোরণ নির্মাণ করা হয়। বর্ণিল সাজে সাজানো হয় পুরো অনুষ্ঠান স্থল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একাধিক ক্রেস্ট ও নানা উপহার তুলে দেওয়া হয় বিদায়ী ইমামের হাতে। নগদ দেড় লাখ টাকাও প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে মুসল্লিদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন ইমাম। গলায় ফুলের মারা পরিয়ে দিয়ে প্রিয় ইমামকে সুসজ্জিত গাড়িতে করে তাঁর বাড়ি গ্রামে পৌঁছে দেন। এ সময় মোটর শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে মিছিল আর শ্লোগানে এক অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হয় পুরো এলাকা জুড়ে। প্রচুর সংখ্যক মোটর সাইকেল ছাড়াও আরো অনেকে সুসজ্জিত প্রাইভেট কার নিয়ে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। 

 

মাওলানা মাহমুদুর রহমানের বাড়ি একই উপজেলার খলাছড়া ইউনিয়নের লোহারমহল গ্রামে। স্ত্রী-সহ তাঁর রয়েছে ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে। ছয় ছেলের পাঁচ ছেলে হাফেজ, এক ছেলে কলেজে শিক্ষা জীবন শেষে এখন প্রবাসে। এছাড়া নাতিরাও আলেম এবং হাফেজ।

 

ইমামতির শুরুতে তিনি সম্মানি পেতেন ৩৫ টাকা। বিদায়ের সময় তাঁর মাসিক সম্মানি কত ছিলো? সেটা যদিও ৩৫ টাকার ১০০ গুণ, কিন্তু বর্তমান সময় অনুযায়ী অনেক কম। বিদায়ের সময় তিনি সম্মানি পেতেন মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। ১৯৬৫ সালে একজন পাঠশালা শিক্ষকেরও বেতন ৩৫ বা ৪০ টাকা ছিলো, সেই সময় বড় হুজুরের এই সম্মানি কম ছিলো কিনা জানিনা, কিন্তু বর্তমানে প্রাইমারির শিক্ষক কি তিন/চার হাজার টাকা বেতন পান? যাহোক, মূল প্রসঙ্গে চলে আসি। 

 

সুপ্রাকান্দি জামে মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি মাওলানা মাহমুদুর রহমান স্থানীয় ঈদগাহ বাজার মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ৩৮ বছর। দলমত নির্বিশেষে তিনি এলাকায় একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ”আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব সময় সততার সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেছি। কখনো ভাবিনি, আমার বিদায়টা এত সম্মানের হবে। আমি এমন উদ্যোগের জন্য মসজিদের মুসল্লী, এলাকার ছাত্র ও যুব সমাজ, প্রবাসী, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আবেগাপ্লুত।”