মক্তব: শিশুর নৈতিক শিক্ষার প্রথম পাঠশালা

আবু তালহা তোফায়েল:

মক্তব শিক্ষা হচ্ছে শিশুদের ঈমান বৃদ্ধির দুর্গ, ধর্মীয় মূল্যবোধের পাঠশালা, ঈমান জাগানিয়া শিক্ষা ও কোরআন মাজিদ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর। মক্তব মুসলমানদের আদি ও মৌলিক শিক্ষাক্রম। একজন মুসলমান হিসেবে যতটুকু জ্ঞানার্জন জরুরি, তার সিংহ ভাগ মক্তব থেকেই অর্জন করা সম্ভব।

একসময় ভারতীয় উপমহাদেশে মসজিদে মসজিদে চালু হয় মক্তব শিক্ষা, যার মাধ্যমে প্রতিটি শিশু ইসলামের মৌলিক জ্ঞানগুলো অর্জন করতে পারে।

বিশেষ করে, ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার লাভ করে এবং এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এর যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। মক্তবে সহিহ-শুদ্ধভাবে সুরা-কিরাত পড়ার যোগ্যতা অর্জন, বিশুদ্ধভাবে নামাজ আদায়ের মাসয়ালা শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে অজু, গোসল, তায়াম্মুম, দোয়া-দরুদ, কলেমা, নামাজ, রোজা, মৃত ব্যক্তির গোসল, কাফনের কাপড় পরানো, দাফন করার নিয়মসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় শেখানো হয়।

মক্তব শিশুদের নৈতিক  শিক্ষার পাঠশালা

মক্তবে কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও বড়দের সালাম এবং সম্মান দেওয়া, সুন্দর ও মার্জিত ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়।

আর শৈশবেই এ আলোকে সন্তানদের গড়ে তোলা না গেলে কারণে-অকারণে সে সুযোগ হয়ে ওঠে না। বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি আল্লামা ইকবাল (রহ.) মক্তব সম্পর্কে কবিতা লিখেছেন। তার সারমর্ম হলো, যদি এ মক্তব-মাদরাসা না থাকত, তাহলে মুসলমানের সন্তানরা নৈতিকতা হারিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানের অন্ধ অনুসরণে নিজেদের পরিচয়টুকুও হারিয়ে ফেলত। মুছে যেত মুসলমানের আদর্শ, স্বকীয়তা ও আত্মগৌরব।

মক্তবের গুরুত্ব ও সফলতা

সকালের মক্তবে যারা পড়েছে, তাদের সহজে কেউ ঈমান হারা করতে পারে না। শিশুর মন নরম কাদামাটির মতো। এই হৃদয়ে যখনই সে গেঁথে নিয়েছে—‘আমানতু বিল্লাহি কামাহুয়া ও আমানতু বিল্লাহি ওমালা ইকাতিহি…।’ তখন তার হৃদয়টা শক্ত ঈমানে বেষ্টিত হয়েছে। লোভ-লালসা কিংবা দুনিয়াবি কোনো কারণে ফরজ বিধানগুলো সাময়িক ছেড়ে দিতে পারে; কিন্তু ঈমান কখনো ছাড়বে না।

একটি পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে, বিশ্বের আধুনিক দেশগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যেকোনো ধর্মেরই হোক—অনায়াসে নাস্তিকদের দল বড় হচ্ছে, ধর্ম থেকে সরে আসছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে মক্তবের তখনকার সময়ে গুরুত্ব ছিল, নিকট-অতীতেও বাংলার প্রায় প্রতিটি পাড়া মহল্লায় মক্তবের ব্যাপক চর্চা ছিল। বাংলার পথে-ঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে মক্তবগামী কোরআনের পাখিদের দেখা মিলত। আর এটাই মক্তবের সফলতা।

অবস্থার পরিবর্তন

মক্তব নিয়ে ষড়যন্ত্র করে আসছে কয়েক দশক পূর্ব থেকে। গত দুই দশক থেকে তারা কিছুটা সফল বললেও ভুল হবে না। সিলেট শহরের একজন ইমাম সাহেব যিনি দীর্ঘ দেড় যুগ থেকে ইমামতি ও মক্তবের দায়িত্বে আছেন। তাঁর কাছ থেকে যে ফলাফল শুনেছি, তা চোখ কপালে ওঠার মতো। ২০০৫ সালে যে মক্তবে ১০০ শিক্ষার্থী ছিল, বর্তমানে সেই মক্তব চলে ২০ জন শিক্ষার্থী দিয়ে। তাও মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে, বিকালবেলায় শিক্ষার্থীরা আসে, ভোরবেলায় এক্সাম-প্রাইভেট অথবা ঘুমের টাইম। যে কয়জন শিক্ষার্থী ভোরবেলা আসে, পারিবারিকভাবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, যৌথ পরিবার, বায়োবৃদ্ধ দাদা-দাদি পরিবারে আছে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী—এমন পরিবারের সন্তানরাই আসে। অথচ মহল্লায় বসতি বেড়েছে, মুসলিম শিশুসংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষার্থী কমেছে। কারণ খুঁজলে দেখা যায়, মক্তবের গলার কাটা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেগুলো প্রথমে মর্নিং স্কুলের বেশে এ দেশে প্রবেশ করেছে।

করণীয়

মক্তবের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। মক্তবের ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে এই পরিস্থিতি উত্তরণে যে যেভাবে হোক, শিশুদের জন্য ভোরবেলা ফ্রি টাইম বের করতে হবে। অথবা ‘আফটার স্কুল’ উপযুক্ত সময়ে তাদের মক্তবমুখী করে আবারও সোনালীি ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া সম্ভব।

সংগৃহিত: দৈনিক কালের কন্ঠ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *