প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইলম অর্জন করা ফরজ। ইসলামের জ্ঞান না থাকলে ধর্ম মোতাবেক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। আর ধর্মীয় শিক্ষার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। শিশুমনে ইসলামের বীজ বুনে দেয় মক্তব। ইসলামের সূচনাকাল থেকেই মসজিদকে কেন্দ্র করে চলে আসছে মক্তব শিক্ষার কার্যক্রম।
মক্তবের যাত্রা প্রাচীন আমল থেকে শুরু হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে বড় বড় মুসলিম মনীষীগণ মক্তব থেকেই প্রথম শিক্ষা লাভ করেছেন। এ উপমহাদেশে সিন্ধু বিজয়ের পর মুসলিম বিজেতারা মুসলমানদের শিক্ষার জন্য মক্তব ও মাদরাসা চালু হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ অঞ্চলে বড় বড় দরবেশ, সুফি, জ্ঞানী, সাধকগণ এসে ইসলামের বাণী প্রচার করে গেছেন। তারা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব, হেফজখানা।
ধীরে ধীরে মুসলমানরা পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে যায়। ইসলামের বাহকগণ যেখানে গেছেন সেখানেই তারা গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠান। অনেক লোককে বলতে শোনা যায়, আমি জীবনে কোনোদিন স্কুলের ধারে-কাছে যাইনি। কিন্তু মক্তবে যাইনি, এমন কথা বলার মতো মানুষ সমাজে পাওয়া মুশকিল। এই হলো মক্তব শিক্ষার প্রভাব ও বিস্তৃতি। এভাবেই মক্তব শিক্ষা মুসলিম সমাজের অন্যতম সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মুসলিম হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য মক্তব শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে কেমন যেন এই যাত্রা স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যাপক উৎকর্ষতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব ব্যবস্থা। একসময় গ্রাম অঞ্চলে মায়েরা ভোরে উঠে ফজর শেষে সুললিত ধ্বনিতে কুরআন তেলাওয়াত করত। সন্তানদের মক্তবে পাঠানোর ব্যবস্থা করত। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যাপকতায় আজ সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
ফলে বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম সন্তান কুরআনবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। সহিহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে না জানার কারণে তারা কুরআনের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে আজ ইসলামের সেই সোনালি অধ্যায় হারিয়ে যেতে বসেছে। মক্তবগুলো আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আগেকার মায়েরা ফজর নামাজ পড়ে সন্তানদের মক্তবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ত।
বর্তমানে সেটা হারিয়ে গেছে। এখন রাত-গভীরে ঘুমানোর কারণে ফজরের সময় অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকে। ফলে মুসলিম শিশুরা হারিয়ে ফেলছে ইসলামের আবহমান কালের ঐতিহ্যের শিকড়। অনেক মক্তব রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও যা চালু আছে, সেগুলোতে আগের মতো আনন্দ নেই, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নেই, নামে মাত্র চলে।
যেহেতু মক্তব থেকে শিশুদের নৈতিক শিক্ষার যাত্রা শুরু, তা যদি হারিয়ে যায়, তা হলে আমাদের সামনেই আমাদের শিশুরা নৈতিকতাবিবর্জিত অবস্থায় বড় হয়ে উঠবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কেননা আজকের শিশু আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে। সেই শিশুরা সুন্দরভাবে বেড়ে না উঠলে সভ্য সমাজের আশা করা যায় না। মক্তব শিক্ষার ঐতিহ্য যদি ধরে রাখা না যায়, তা হলে এটা নিশ্চিত যে, ঈমান-আকিদায় সমৃদ্ধ মুসলমান জাতি ভবিষ্যতে একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। শিশুদের জীবনের প্রথমভাগে ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষা দেওয়া না হলে তাদের মনে ইসলাম সেভাবে স্থান পাবে না। ফলে পরবর্তী জীবনে নানা অপকর্মে জড়িয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই মক্তব শিক্ষাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষায় চেষ্টা করা সবার নৈতিক দায়িত্ব।
সূত্র: দৈনিক সময়ের আলো