মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞান অর্জনের তেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও ইসলামের আদি শিক্ষাকেন্দ্র মসজিদ ছিল। হযরত আদম (আ.) দুনিয়াতে এসে পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন। এটিই মূলত মানব জাতির প্রথম শিক্ষাগার। মহান আল্লাহতায়ালার অমীয় বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য আল্লাহতায়ালার রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র মানব জাতির শিক্ষক হিসেবে অবর্তীণ হন। আমাদের দেশে ইসলামের আগমন ওলী-আউলিয়াগণের মাধ্যমে হলেও ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে মক্তব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সত্যিকার অর্থে একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য মক্তবের বিকল্প নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামি শিক্ষার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী এক প্রকার উদাসীনতা বিরাজ করছে। অথচ যে সমাজ যত বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে সমাজ তত বেশি উন্নত, এটা ইতিহাসে প্রমাণিত। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে গড়ে তোলার পেছনে মক্তব শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র মানবজাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল করেছেন। এই গ্রন্থের ধারক-বাহক হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ আমাদের মনোনীত করলেও আমরা কোরআনের শিক্ষা থেকে বহু দূরে চলে গেছি। সুরা ফাতিরের ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি আমার বান্দাদের মাঝে তাদের সে কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি, যাদের পছন্দ করেছি। সুতরাং কোরআনের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিটি মানুষের জ্ঞানার্জন করা ফরয। আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরআন পাঠের উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে কোরআন নিজে শিখে এবং অন্যকে শিখায়।’ (বোখারি-৫০২৮)। কোরআনের মোজেযা জানার জন্যে বড় আলম হওয়ার প্রয়োজন নেই। একটু ঠান্ডামাথায় চিন্তা করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীতে এমন কোন গ্রন্থ আবিষ্কার হয়নি যে গ্রন্থ প্রতিটি মুর্হুতে মানুষ পড়ে। অথচ আল্লাহতায়ালা সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতের জন্য এমন একটি গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন যা বিশ্বের সব ভাষাভাষি মানুষের জন্য একই ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। কোরআন শিক্ষা করা, মুখস্থ করা ও তাতে দক্ষতা লাভের ফজিলত এত বেশি যা হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও সমাপ্তি টানা সম্ভব নয়। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করবে এবং তা মুখস্থ করবে এবং বিধি-বিধানের প্রতি যত্মবান হবে, সে উচ্চ সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে অবস্থান করবে। আর যে কষ্ট হওয়া সত্তে¡ও কোরআন পড়বে, তার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবে সে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে।’ (মুসলিম: ২৪৬৫)।
মুসলিম সুলতানি যুগ থেকে শুরু করে মোগল আমল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৮০০ বছর মুসলমানদের নিকট ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব ছিল প্রবল। প্রতিটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শাসকরা। কিন্তু ব্রিটিশ বেনিয়ারা ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজধানী শহরের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম গাঁও-গেরামের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় হাজারো মক্তব-মাদরাসা ছিল। শিশু-কিশোররা কায়দা-সিপারা হাতে নিয়ে মক্তবে যেত। বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠানোর আগে মক্তবে পাঠাতো। এমনকি গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মহিলারা কোরআনের শিক্ষার প্রসারের জন্যে পাটি, মাদুর বিছিয়ে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করত। সে সময় কোরআন পড়ার বেশ কদর ছিল। বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রেও কোরআন পড়তে পারে এমন পাত্রীদের তালাশ করা হতো। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। মুসলমানদের ঐতিহ্যের ধারক মক্তবগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। শিশু-কিশোররা এখন আর দলবেঁধে মক্তবে যায় না বা যেতে দেয়া হয় না। দেশের কি শহর, কি গ্রাম সর্বত্র আজ মক্তবের সময় কিন্ডার গার্টেন স্কুল চালু করা হয়েছে। একশ্রেণির অভিভাবক মক্তব শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন হওয়ায় শিশুদের কচি মনে ইসলামী মূল্যবোধের পরির্বতে বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রথিত হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব আমলের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের ধারাবাহিকতা জারি থাকে। এক. সদকায়ে জারিয়া। দুই. কোনো এলমের মাধ্যম রেখে যাওয়া, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে। তিন. নেক সন্তান রেখে যাওয়া যে তার জন্য দোয়া করবে।’ (মুসলিম: ১৬৩১)। যে ঘরে কোরআন তেলাওয়াত হয়, সে ঘরে আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হয় যা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন লোকেরা কোনো ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব কোরআন পাঠ করে, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয় এবং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের আলোচনা করতে থাকেন।’ (মুসলিম ২০৭৪)। কেয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি মর্যাদাশীল হবেন কোরআনের পাঠক। সেদিন বলা হবে, পড় যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে। তোমার পড়া যেখানে শেষ হবে সেখানেই হবে তোমার স্থান। (মুসনাদে আহমদ ১৯২)। পৃথিবীতে এমন একটি গ্রন্থ কী খুঁজে পাওয়া যাবে যে গ্রন্থের একটি শব্দ পড়লে দশটি নেকী পাওয়া যায়। অথচ কোরআনের একটি হরফ পড়লে একটি নেকি হয়। আর একটি নেকি দশ নেকির সমান। (বোখারি: ৬৪৬৯)। কোরআন তেলাওয়াতের এই সম্মান শুধুমাত্র তেলাওয়াতকারী নিজেই পাবে তা কিন্তু নয়! মা-বাবাকেও দেয়া হবে সম্মান। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে ও তদনুযায়ী আমল করে, কেয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে নূরের মুকুট পরানো হবে, তার আলো হবে সূর্যের আলো অপেক্ষা প্রখর। (আবু দাউদ ৩৬৭৫)। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল-কলেজ থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ ছেলে মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করছে, এটা ঠিক। কিন্তু আমরা যদি চিত্রের উল্টো পৃষ্ঠের বিষয়টি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাবো, ওইসব জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলে-মেয়েরা নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে যথেষ্ট উর্ত্তীণ নয়। এটা দেশ সমাজ ও জাতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। সত্যিকার অর্থে একটি সোনার বাংলাদেশ গঠন করতে চাইলে মক্তবশিক্ষার প্রসার রাষ্ট্রীয়ভাবে বাড়ানো জরুরি। দেশের নাগরিক সমাজ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনবিদ, মসজিদের সম্মানিত খতিব, ইমাম সাহেব, অভিভাবকগণ সকলের নিকট জোর আবেদন জানাচ্ছি, হারিয়ে যাওয়া মক্তবশিক্ষা পুনরায় চালু করার ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করুন।
সংগৃহিত: দৈনিক ইনকিলাব