নিভু নিভু মক্তবের দীপশিখা..

সংগৃহিত

আলিফ যবর- আ। বা যবর- বা। তা যবর- তা। অসংখ্য মকতবে পাখির মতো নিষ্পাপ শিশুদের কুজন-কলরবে মুখরিত এ সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের প্রতিটি রোদরাঙা শিশির ভেজা সকাল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা টুপি পড়ে ওড়না জড়িয়ে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে দল বেঁধে ছুটে চলে পাড়ার মসজিদের দিকে। মসজিদের ভেতরে বা চত্বরে ইমাম মুয়ায্যিন বা নির্ধারিত উস্তাদ তাদেরকে যতœ সহকারে কায়দা আমপারা শেখান। বোর্ডে চক দিয়ে আরবি হরফ লিখে দেখান। আরবি ভাষার বানান-ব্যাকরণে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠে শিশুরা। সমস্বরে উচ্চারণ করে আল্লাহর নাম, পবিত্র কালেমা, কুরআনের আয়াত, নবিজীর হাদিস, দোয়া, মাসায়েল আরো অনেক কিছু। জপতে জপতে শেখে, লিখতে লিখতে শেখে, ধাপে ধাপে ইসলামের মৌলিক ক্রিয়াকলাপ (আমল) হাতেকলমে আয়ত্ব করে কোমলমতি শিশুরা। এটি ইসলামি শিক্ষার ভিত্তিমূল। সেই সাথে গ্রাম-বাংলার আবহমান ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল বাঙালি সংস্কৃতিও বটে। একেকটি জাতি ও জনগোষ্ঠীকে ঘিরেই গড়ে ওঠে পৃথিবীর নানা দেশ ও মানচিত্র। সে দেশের মানুষের সামাজিক, চারিত্রিক ও ধর্মীয় ভাব-বৈশিষ্ট্যকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিম-ল। ধর্মবিশ্বাসে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ মুসলমান হওয়ায় ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতিই এখানকার জাতীয় সংস্কৃতির মূল নিয়ামক। এদেশের শিশুরা মুসলিম প্রজন্ম, মুসলমানের সন্তান। এরা বড় হয়ে নিজ নিজ জীবন ও কর্মে যে অবস্থানই অর্জন করুক, এদের মৌলিক চিন্তাচেতনা ও জ্ঞান হতে সুমহান ইসলামের আলোকে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইসলামের বিশ্বাস ও কর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া এদেশের প্রায় সকল নাগরিকের জন্য বাঞ্ছনীয়। এটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারও। যার পৃষ্ঠপোষকতার প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের সামাজিক, নাগরিক, মানবিক, নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে যেমন বাধ্য, ঠিক তেমনি নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকারগুলোও যথাযথ পূরণে দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামি শিক্ষার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হতাশাব্যঞ্জক উদাসীনতা বেশ বেদনা ও বিষ্ময়ের। উপরন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অসার চিন্তা থেকে এদেশের নব্বই ভাগ নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার ইসলামি শিক্ষাকে যথেষ্ট বিঘিœত ও বঞ্চিতই করা হয়ে আসছে। সুদীর্ঘ কূটকৌশলী প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিদেশি ও বিধর্মী এনজিও তাদের শিশুশিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষার সময়সূচি এদেশের মকতবগুলোর বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে।

দেশীয় কিন্ডার গার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর সময় ও কার্যক্রমও এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যেন জাতির সন্তানরা মকতবমুখী হওয়ার সময়ই না মেলাতে পারে। হচ্ছেও তাই। বর্তমানের শিশুরা কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়েই হাতমুখ ধুয়ে নাকে মুখে সামান্য নাশতা গুঁজেই পিঠে জ্ঞানের বস্তা নিয়ে স্কুল বা প্রাইভেটে ছুট দেয়। একা নয়তো, মা-বাবাসহ। কাজেই ওযু নামাযের অভ্যাস তো দূরের কথা, দীনি শিক্ষার আলিফ-বা-তা-ছা শেখার জন্য মিনিট খানেক সময়ও আর হাতে থাকে না। ওযু, নামায, তিলাওয়াত হয় না অনেক অভিভাবকেরও।

একটি সন্তান যদি ভোর থেকেই স্কুল, প্রাইভেট কোচিং বা হোমওয়ার্ক নিয়ে সারাটা দিন ব্যস্ততায় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে যায়, তা হলে একটু খাওয়া, ঘুম, গোসলের ফাঁকে তার বিশ্বাসের দীক্ষাটি নেবার সুযোগ সে কী করে পাবে ? নামাযি পরহেযগার দাদাদাদি বা পিতামাতা হলে তবু রক্ষেÑ আধুনিক শিক্ষার ঘোড়দৌড়ের ফাঁকে আবছা করে হলেও শিশুটি হয়তো নামায কুরআনের কিছু বিষয় চোখে দেখার সুযোগ অন্তত পাবে, কিন্তু বিপরীত হলে তো সীমাহীন দুর্ভাগ্যই বলতে হবে তার। যে মুসলিম শিশুটিকে ইসলাম শেখার সময়ই দেয়া হলো না, পরিবার থেকে দেখে শেখারও সুযোগ হলো না, ইসলামি জ্ঞান ও আদর্শের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না তার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকালেও, বাস্তবজীবনে সে ইসলামবিমুখ বা ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকে পরিণত হতে পারে খুব সহজেই। এরাই পর্যায়ক্রমে হবে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষক, গবেষক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক, অথচ গোড়া থেকে আগা পর্যন্তই তাদের চিন্তাচেতনা ও প্রবণতা থেকে যাবে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামশুন্য, তখন কী হবে এদের অবস্থা, আর কী হবে এদেশের ইসলামের!

‘হবে’ বলাটাও পুরোপুরি সঠিক নয়, কারণ ইতিমধ্যে হতে শুরু করেছে। এ অবস্থাটি আরও তীব্র ও ঘণীভূত হোক, এ চিন্তা ও ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাও চলছে দেশি বিদেশি অনেক মস্তিষ্কেও। সতর্ক হওয়ার এবং সমুচিত পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়।

ইসলামের আবির্ভাব এবং স্থিতিশীল অগ্রযাত্রার শুরুতে মসজিদে নববি কেন্দ্রিক ইলমে দীন বা ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার কাজ শুরু হয়। মসজিদভিত্তিক ইসলামি শিক্ষার এ ধারা যুগে যুগে চলে আসছে হাজার বছর আগে থেকেই। মসজিদই হচ্ছে ইসলামি চিন্তা, কর্ম, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিক্ষা ও সামাজিকতার কেন্দ্রস্থল। এ কারণে যেখানেই মসজিদ সেখানেই কুরআন ও শরিয়ত শিক্ষার ব্যবস্থা ধারাবাহিক ঐতিহ্য এবং অনিবার্য।

এর নজির বাংলাদেশেও বহুকাল ধরে চলে আসছে। এ ছাড়াও নানা পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় দীনি শিক্ষার চর্চা ও প্রসার চলে থাকে। বাংলাদেশ অসংখ্য অগণিত মসজিদের দেশ। দেশের প্রায় প্রতিটি পাড়া মহল্লা গলি ও বাজারে ছোট বড় মসজিদ আছেই। এসব মসজিদে ভোরসকালে মকতব চলার ঐতিহ্য নতুন নয়। কোটি কোটি মুসলমানের দেশে এর কোনো বিকল্পও নেই।

এই মকতবগুলো একদিকে লক্ষ লক্ষ কচি শিশুর ধর্মীয়, আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি শিক্ষকতার পেশায় অসংখ্য আলেম হাফেজের কর্মসংস্থানের ভূমিকাও রাখে। এগুলোর মাধ্যমে স্বাক্ষরতা এবং প্রাথমিক গণশিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতিও হয়ে থাকেÑ যা রাষ্ট্রের নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে দারুন সহায়ক। কাজেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও সার্বিক সমর্থক-সহায়তা এসব মকতবের প্রাপ্য। বিপরীত কিছু পরিলক্ষিত হলে তা অবশ্যই হীন উদ্দেশ্যমূলক এবং পূর্বপরিকল্পিত অভিসন্ধি হতে বাধ্য।

যদিও মসজিদভিত্তিক মকতব ছাড়া স্বতন্ত্র মকতব, বড় মাদরাসাকেন্দ্রিক মকতব, গৃহশিক্ষকভিত্তিক মকতব, বা কিছু অনিয়মিত মকতবও রয়েছে, তবুও মসজিদভিত্তিক মকতবই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, ফলপ্রসূ, সহজপ্রাপ্য এবং প্রয়োজনীয়। সমাজের যে শিশুরা সুবিধাবঞ্চিত, অথবা যারা সাধারণ শিক্ষার পথেই এগুতে আগ্রহী, সবাই মসজিদে এসব মকতবে জীবনের প্রথম ধাপে ঈমান ও ইসলামের মজবুত ভিত্তিটি মনমস্তিষ্কে গ্রহণ করার সুযোগ পায়। পূর্ববর্তী জীবনে সে যাই হোক, যাই করুক, যেভাবে যেখানেই থাক, শৈশবে উপার্জিত বিশুদ্ধ ধর্মীয় জ্ঞান ও আমলের অনুশলীনটি তার সঙ্গেই থাকে। নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষার ছাপ পড়ে তার জীবন ও কর্মের প্রতিটি ধাপে। সে যদি বাকি জীবন ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতির অনুকূল সুযোগ আর নাও পায়, তবুও তার সে শৈশবের পবিত্র জ্ঞানটুকুই তাকে আলোর পথটি চিনতে সাহায্য করে। মকতব নামের এই বিস্তীর্ণ সূক্ষ্ম ও ক্ষুদে দ্বীপশিখাগুলো নিভে গেলে যে জাতিকে দীনের পথে ধরে রাখা বড় মুশকিল হয়ে পড়বেÑ এটা দীনের দুশমনদের ভালো করেই জানা আছে। আর তাই মকতবকে বন্ধ, নিস্ক্রিয় অথবা চরম বিঘিœত ও বাধাগ্রস্থ করার এই নানাবিধ অপপ্রয়াস। মকতবের পাশেই দাতব্য স্কুল স্থাপন, মকতবের সময় ধরেই স্কুলের সময়সূচি নির্ধারণ, মকতবের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি প্রত্যাহার, এমনকি শহর থেকে পাড়া গা পর্যন্ত মুসলিম শিশুদের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে স্কুল- কোচিংয়ের দৌড়াতে অভিভাকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ বিষয়টি এখন দেশের সর্বত্র বাস্তবদৃশ্যে পরিণত হচ্ছে এবং সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তা ঘটছে। আগে তো এতো পড়াশোনার তোড়জোর ছিল না! এখন শুধু শহরে নয়, বদ্ধ গ্রামেও আধুনিক শিক্ষার সরগরম উপস্থিতি ঘটছে। বিষয়টি জাতীয় মুক্তি ও উন্নয়নের জন্য আবশ্যক বটে, তবে ব্যাপারটি কি আধুনিক শিক্ষা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তারের জন্য ঘটছে, না এ বাংলাদেশের তৃণমূল থেকেও ইসলামি তথা ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষাকে সংকুচিত করে আনার লক্ষ্যে ঘটছে, তা আজ সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।

তবে হ্যাঁ, এ সংকটের বিকল্প সমধানের পথও উন্মোচিত হতে শুরু করেছে নানাভাবে। কথায় বলে ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা’ নিতে হয়। যারা এ অবস্থাটির প্রতিকার চাচ্ছেন বা করছেন তারাও চিহ্নিত ও বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন অপশক্তির দ্বারা। দীন ও ঈমানের এ ক্রান্তিক্ষণে বহুমুখী শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা যারা করতে সচেষ্ট, জাতি বা জনগণের উচিত তাদের পাশে থেকে আদর্শ ও বিশ্বাস রক্ষার এ লড়াইয়ে শরীক হওয়া। নয়তো নামধারী মুসলিমের সংখ্যা বাড়িয়ে, প্রকৃত ঈমানদার ও দীনের পাহাড়াদার মুসলমানের সংখ্যা দিনদিন কমিয়ে ইসলামের এ পূণ্যভূমিকে ঈমান আমল ও চেতনাশূন্য করে দিতে শত্রুর বেশি সময় লাগবে না। সময় এখন তাই জেগে ওঠার। সময় এখন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের। সময় এখন, যে করেই হোক বাংলাদেশের শিরাউপশিরায় মকতবের দীপশিখা জ্বেলে রাখার; নতুন করে জ্বালাবার।

ফোরকানিয়া মক্তব মুসলিম শিশুশিক্ষার কার্যকর পদ্ধতি:

শিক্ষা : আর আল্লাহ তাআলা শেখালেন আদমকে সমস্ত কিছুর নাম। সুরা বাকারা, আয়াত-৩১। আর যখন তোমার পালনকর্তা বনি-আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তার সন্তানদের এবং নিজের উপর তাদের প্রতিজ্ঞা করালেন, ‘আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই?’ তারা বলল, ‘অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি।’ আবার না কেয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। সুরা আরাফ, আয়াত-১৭। করুণাময় আল্লাহ। শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা। (সুরা রাহমান, আয়াত ০১-০৪)

যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সুরা আলাক, আয়াত ০৪-০৫)

প্রত্যেক শিশু ফিতরতের (ইসলাম/সত্য গ্রহণের যোগ্যতা) উপর জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু পরিবার ও সমাজ তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নিউপাসক বানায়। আল-হাদিস। পবিত্র কুরআনের এসব আয়াত এবং উক্ত হাদিসের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই শিক্ষাপ্রাপ্ত। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন অথবা সৃষ্টি করেই শিক্ষা দিয়েছেন, অথবা দুটোই। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ শিক্ষাপ্রাপ্ত হলে আমরা নতুন করে আর কী শিখব, কেন শিখব?

শিক্ষা দুই প্রকার। প্রাপ্ত শিক্ষা ও বৈষয়িক বা অর্জিত শিক্ষা। উপরে যে উদ্ধৃতিগুলো দেয়া হয়েছে তা প্রাপ্ত শিক্ষার প্রমাণ। মানুষের জীবনের যা চাহিদা, সীমাহীন আশা-আকাঙ্খা, রহস্য নিয়ে চিরকালীন প্রশ্ন, জানতে চাওয়া, কোনো এক মহাশক্তির প্রতি অজানা আকর্ষণ, দুঃখ-কষ্ট ও চরম পর্যায়ের অশান্তিতে ভোগার বাধ্যবাধকতা, বিপরীত শক্তির প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণ, জীবনের শেষদিনের পর্বতপ্রমাণ হতাশা- এসব সমাধানে যে শিক্ষা ও জ্ঞান দরকার তা মহান আল্লাহ অসীম করুণায় মানবজাতিকে জানিয়ে ও শিখিয়ে দিয়েছেন। তবে পৃথিবীতে আসার পর বিভিন্নমুখী বাধা প্রতিবন্ধকতা এ শিক্ষা ও জ্ঞানের উপর আবরণ সৃষ্টি করার মাধ্যমে তা ঢেকে ফেলে। সুতরাং আমাদের প্রচেষ্টা হবে এসব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করা; আবরণ ভেঙ্গে ফেলা। যেমন কৃষক জমিনে বীজ ফেলার আগে-পড়ে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে কাজ করে। সবকিছু করার পরও বীজের অঙ্কুরোদ্গম না ঘটলে কৃষকের কিছু করার থাকে না। সব বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়ও না। আবার বীজ সেদ্ধ করে ফেললে বা সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে বীজের ভেতরের শক্তিটা নষ্ট হয়ে যায়। তখন শত প্রতিবন্ধকতা দূর করলেও কার্যকারণে বীজ ফলবে না। ডিমের উপর মুরগি তা দিয়ে এর ভেতরের শক্তিটিকে জাগ্রত ও বিকশিত করে এবং বাহিরের আবরণটা ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু ডিম সেদ্ধ করে ফেললে বা কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেলে তখন আর শত চেষ্টা করেও লাভ হবে না। হাঁসের বাচ্চা জন্মের পরই সাঁতার কাটতে পারে। মানুষ শেখার পর পারে। কোনো কোনো প্রাণী শিখেও পারে না। এ সূত্রে এখানে আমরা বুঝলাম সৃষ্টিগতভাবে যাকে যে শিক্ষা ও শক্তি দেয়া আছে তা উপযুক্ত পরিবেশে রেখে প্রতিবন্ধকতা দূর করলেই বিকশিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে, বোধসম্পন্ন লোকদের জন্যে। (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-১৯০)

এরা কি লক্ষ্য (চিন্তা-গবেষণা) করে না কোরআনের প্রতি? (সুরা নিসা, আয়াত-৮২)

হাদিস শরিফে বলা হয়েছে ইলম ‘তলবের’ জন্য, শেখার কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ যা শেখা হয় বা শিখতে হয় তা সাধারণত ‘ইলম’ নয়। একে আমরা অর্জিত শিক্ষা বা অর্জিত জ্ঞান বলব। আর যা চিন্তা-গবেষণা ও তলব করে বিকশিত করতে হয় তাকে আমরা প্রাপ্ত শিক্ষা বলব।

প্রত্যেক মানবসন্তান সৃষ্টিগত ও জেনেটিকভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত। আদি পিতা হযরত আদমকে আ. আল্লাহ কর্তৃক শেখানো জ্ঞান, তার তিনশ বছরের কান্নার প্রভাব, মহান আল্লাহকে ভয়ের প্রভাব জেনেটিকভাবে আমরা ধারণ করি। তবে এর উপর পরিবেশ-পরিস্থিতি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বংশীয় নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের আবরণ তৈরি করে। তাই এ শিক্ষা বিকশিত করতে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের কাজটা শুরু হয় পিতা-মাতার বিবাহের অনেক পূর্ব থেকেই; শৈশব থেকেই। একজন সন্তানের সবচেয়ে আপন, উত্তম, ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হচ্ছেন তার মা, এরপর বাবা। একজন সন্তানের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। পরিবার হচ্ছে মানবসমাজের একক ইউনিট। পরিবার মানবসন্তানের শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি। তবে হ্যাঁ, বিভিন্ন কারণে আমাদের পরিবারগুলো দুর্বল হয়ে পড়ায়, পারিবারিক-সামাজিক পরিবেশ দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাওয়ায় এবং অধিকাংশ পিতামাতার পক্ষে সন্তানের প্রকৃত শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতার প্রকাশ না ঘটায় এর ঘাটতি পূরণের জন্য ধীরে ধীরে আমরা সামাজিক বলয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এছাড়াও যুগ-সমাজের বহুমুখী চাহিদা বৃদ্ধি ও নিত্যনতুন আবিষ্কার-উদ্ভাবন অর্জিত শিক্ষার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে যা, শুধুই পরিবারে এবং ব্যক্তিগতভাবে সম্ভব নয়। তবে প্রকৃতপক্ষে মায়ের দুধের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি মানুষের জন্য জেনেটিক ও পারিবারিক শিক্ষারও কোনো বিকল্প নেই।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিশুশিক্ষা

যাহোক, আজ আমরা সামাজিক বলয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়েই কথা বলব। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। মানবশিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। শিশুশিক্ষা হচ্ছে মানুষ গঠনের ভিত্তি। ভিত্তি যত মজবুত ও দৃঢ় হবে, এর ওপর ততই উন্নতি ও সমৃদ্ধি করা যাবে। শারীরিক-মানসিক-আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, আদর্শ গুণাবলির স্ফূরণ, ব্যক্তিত্ব ও মনুষত্বের বিকাশ, প্রবল প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলার শক্তি অর্জন এবং এক একজন শিশুমানবকে পরিপূর্ণ ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে শিশুশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর পাক-ভারত উপমহাদেশের শিশুশিক্ষার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে ফোরকানিয়া মক্তব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে বঙ্গদেশের আনাচেকানাচে হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও ফোরকানিয়া মক্তবের ইতিহাস অতি প্রাচীন। মূলত এ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই তৎকালীন মুসলিম সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার চাহিদা পূরণ করেছে। আজ শহরের আনাচেকানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে কিন্ডার গার্টেন রেসিডেন্সিয়ালজাতীয় কিছু নীতিবর্জিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্যাঙের ছাতাও আজকাল শহরে খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু ওসব ভূঁইফোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠতে শহরই যেন উর্বর ক্ষেত্র। সন্তান মায়ের গর্ভে থাকতেই এমন কী এরও আগে এরা ‘স্টুডেন্ট’ বুকিং দিয়ে রাখে। সম্ভবত বিশেষ একটা শ্রেণি মক্তবশিক্ষাকে ধ্বংস করতেই পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে প্রথমে কিন্ডার গার্টেন পরে রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল যা ভোর সকালেই অর্থাৎ ঠিক মক্তবের সময় শুরু হয়। অবশ্য আমরা বিষয়টা এভাবেও দেখতে পারি যে, যুগের চাহিদানুযায়ী এগুলো এসেছে। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, মক্তবশিক্ষাকে যুগোপযোগী করে সাজানো। নতুন উদ্যোগে নতুন উদ্যমে শুরু করা। এর একটা রূপ এই হতে পারে, প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদ্রাসাগুলো দায়িত্ব নেয়া। প্রকৃতপক্ষে সারাদেশের মক্তব শক্তিশালী করা এখন কওমি মাদ্রাসাগুলোরই দায়িত্ব; তাদের নিজস্ব প্রয়োজনেই। মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা, এর উন্নয়ন, পরিচালনাসহ সামগ্রিক দায়িত্ব শুধু ইমাম-মুয়ায্যিনগণের উপর ছেড়ে না রেখে সরাসরি কওমি মাদ্রাসাগুলোকেই নিতে হবে। তাহলেই এ থেকে কাঙ্খিত ফলাফল আশা করা যায়।

কওমি মাদ্রাসা
আমাদের সামনে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক ও বৈশ্বিক অসংখ্য সমস্যার পাহাড়। অথচ আমাদের হাত-চোখ-মুখ বাঁধা। চিন্তা-চেতনা বিকৃত। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে ন্যূনতম নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারছে না। শিক্ষার্থীগণ পারস্পরিক শত্রুতামূলক মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠছে। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই শত্রুতার বীজ বুনছে, সেখানে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠবে কীভাবে? স্কুল-কলেজগুলো যদি প্রয়োজনীয় ধর্মশিক্ষার পাঠ সংযোজন করত, তাহলে সমস্যা অনেকটা দূর হয়ে যেত। অথচ আজ এ শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটছে সম্পূর্ণ কমার্শিয়াল দৃষ্টিভঙ্গিতে। যেখানে পিতামাতা হচ্ছেন সন্তানের প্রাথমিক ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, সেখানে মুনাফাখোররা মায়ের কোল থেকেই ‘দায়িত্ব’ নিয়ে নেয়, সন্তানকে পিতামাতার সংশ্রব থেকে বঞ্চিত করে। আর এর পেছনে অজস্র অর্থের অপচয়, নিজে সুদ-ঘুষ খেয়ে সন্তানকে শিক্ষিত করা তো আছেই। সে শিক্ষাটাও মূলত কী? গরীব-শোষণের শিক্ষা, ব্যাংক ডাকাতির শিক্ষা, সুদ-ঘুষ খাওয়া ও সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে জালিয়াতির শিক্ষা। তাই কওমি মাদ্রাসার প্রয়োজনীয়তা জাতি নতুনভাবে উপলব্ধি করছে। বর্তমানে যদিও কওমি মাদ্রাসাগুলো দেশ-জাতির চাহিদা পূরণে যোগ্য নাগরিক তৈরি করতে পারছে না, তবে মানুষ হয়ে গড়ে ওঠবার একটা যোগ্যতা তারা ঠিকই তৈরি করছে। তাদের সবচেয়ে বড় গুণটি হচ্ছে অল্পেতুষ্টি। এখন প্রয়োজন নতুনভাবে শুরু করা। আমি মনে করি স্বাধীনতার পর শুধুই ধর্মীয় চাহিদা পূরণের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈষয়িক জ্ঞান, কারিগরি দক্ষতা ও অন্যান্য যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন ছিল। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্যও এগুলো উন্মুক্ত রাখা বা পৃথক ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। তাহলে একই দেশে আরেকটি ভিন্ন শিক্ষাধারা প্রবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিত না। এ ব্যর্থতা আলেমদের। এখন আমাদের এ দিকটায় নজর দিতে হবে। আর এটা করতে গিয়ে মক্তবশিক্ষার বিপ্লবটা আমরা আবার ঘটাতে পারি। কেননা কওমি শিক্ষাধারা ছিল ফোরকানিয়া মক্তবেরই এক উন্নত সংস্করণ। উপমহাদেশের ইতিহাসে কওমি শিক্ষাধারা এক আজন্ম সংগ্রামের নাম। ব্রিটিশ আমলে মুসলিম সন্তানদের ধর্মীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় কওমি মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে যার সূচনা। ব্রিটিশ আমলে যেমন সরকারি সাহায্য ও আনুকূল্য তাদের কপালে জোটেনি, স্বাধীনতার পরেও কথিত সমাজতান্ত্রিকদের দাপটে রাতারাতি শাসনপদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। এ কারণে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিকাশ লাভ করতে পারেনি।

মক্তব শিক্ষার বিপ্লব
বঙ্গদেশে শিক্ষার ভিত্তিই স্থাপিত হয়েছিল ফোরকানিয়া মক্তবের হাত ধরে। সেটি অনেক আগের (মোগল ও অন্যান্য শাসনামলের ইতিহাস কী বলে দেখুন) কথা। তারপর অনেক উত্থান-পতনের পর আবার ব্রিটিশ আমলেও একই চিত্র আমরা দেখতে পাই। এ অঞ্চলের জনগণ শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। কারণ তখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, বিশেষত মুসলিম সন্তানদের জন্য। সে পরিস্থিতিতে মুসলিম নেতৃস্থানীয়গণ পারিবারিকভাবে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষাক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন। তারপর গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটে। পীর-ফকির, আলেম-দরবেশগণ তা ছড়িয়ে দিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। তা না হলে আজ হয়তো এই বাংলাদেশ সভ্য সমাজ ও বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন থাকত। অথচ কি করুণ সত্য! নতুন প্রজন্মের প্রায় কেউই সে ইতিহাস জানে না। আজ তাদের জানার ব্যবস্থাও নেই। আমাদের পূর্ব পুরুষদের মাঝে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যাদের শিক্ষার হাতেখড়ি ‘মক্তবে’ নয়।

ইসলাম প্রত্যেক মানুষের সৃষ্টিগত ধর্ম। কুরআর সমস্ত জ্ঞানের আকর। পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম। অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয় সে জালেম, অজ্ঞ।’ ৩৩ : ৭২। তাই প্রত্যেক মুসলিম অভিভাবকের উচিত তার সন্তানকে শুরু থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তোলা। প্রয়োজনীয় পরিমাণ কুরআন ও মাসায়েল শিক্ষা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। আর এ প্রয়োজনকে সামনে রেখেই উপমহাদেশের আলেমগণ মক্তব-পদ্ধতির বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। বাপ-দাদা, চাচা-মামা, ফুফু-খালা, নানি-দাদি প্রায় সবাই মক্তবে গিয়েছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আজকের ‘নেতানেত্রীগণও’ একসময়কার মক্তবের শিক্ষার্থী। যদিও বর্তমান কিন্ডার গার্টেন পদ্ধতি সুকৌশলে এর বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। এখনও সারাদেশে ফোরকানিয়া মক্তব আছে ঠিকই, কিন্তু আগের মতো শিক্ষার মান নেই। এমনকি এক্ষেত্রে সমকালীন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত ধর্মীয় শিশুশিক্ষা পদ্ধতি নুরানী-নাদিয়াও ব্যর্থ।

এ ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। শুধুই মৌখিক উচ্চারণ, সম্মিলিত ও সুললিত কণ্ঠে পঠন, হাদিস মুখস্তকরণ ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ না থেকে শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক- সামগ্রিক দিক থেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন পরবর্তী কঠিন চ্যালেঞ্জ সহজে মোকাবেলা করতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মিশে না যায় এবং যেকোনো কর্মক্ষেত্রে নিজের জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। শিশুকালে শিক্ষার বয়স হবার পর এমন শিক্ষা দৈনিক দুই ঘন্টা করে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই দেয়া সম্ভব। আর এ ধরনের শক্তিশালী শিক্ষা ও সহজ পদ্ধতির প্রয়োগ ছাড়া মক্তবশিক্ষার সেই সোনালি ইতিহাস ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও ফোরকানিয়া মক্তব নিয়ে আমার দীর্ঘ অনুসন্ধান ও কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। সেই আলোকে আমি মনে করি বর্তমান অশ্লীল ও নগ্ন-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলায় ফোরকানিয়া মক্তবের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি, পার্শ্ববর্তী প্রতিটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকগণ এবং উপরের ক্লাশের ছাত্ররা পালাক্রমে সপ্তাহে এক বা দুদিন মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার কার্যক্রম হাতে নেয়া। এটা কিছুটা তাবলিগের মতো হবে। পার্থক্য- তারা দূরগ্রামে নিয়ে গিয়ে শেখায়, আমরা স্থানীয়ভাবে শেখাব, কোনো বিনিময় ছাড়া। আমাদের লক্ষ্য থাকবে ৯৫% ভাগ পুরুষকে প্রত্যেক নামাজের সময় স্বতস্ফূর্তভাবে মসজিদে নিয়ে আসা, স্কুলে যায় অথবা যায় না- সব বয়সের ছেলেমেয়ে-নারীপুরুষকে ফরজিয়াতের তালিম দেয়া। পুরুষদের জন্য মসজিদে ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নতে মুয়াক্কাদার মাসায়েল, কমপক্ষে পাঁচখানা সুরা শিক্ষাদান, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত দূরীকরণে আলোচনা, প্রশ্নোত্তর এবং ইমানি ইলম তলবে বিভিন্ন স্তরের পদক্ষেপ নেয়া। মেয়ে ও মহিলাদের জন্য মহিলাদের মাধ্যমে (কোনো আলেমের স্ত্রীও হতে পারেন) আলাদা ব্যবস্থা করা।

মকতব : ইতিহাস ও বর্তমান:
ক : মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। বিশেষ করে সতেরো-আঠারো শতকের বিশ্ব সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু অবগত ছিলেন। আওরঙ্গজেব ইসলামি আইনের সাথে সাথে ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। অথচ ইতি-পূর্বেকার সাড়ে চারশ বছরের মুসলিম শাসনামলে উপমহাদেশের মুসলমানদের উপযোগী কোনো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়নি। কয়েক বছর আগে থেকে বিশ্বের মুসলিম শাসিত এলাকার এ পূর্বাঞ্চলে আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান ও হিন্দুস্থান এলাকায় যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, সেটাই হুবহু এদেশে প্রচলিত থাকে।

কিন্তু এ শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশের বর্ধিষ্ণু মুসলিম সমাজের চাহিদা ঠিকমতো পূরণ করতে পারছিল না। তারপর আকবরের ‘দ্বীনে ইলাহী’র প্রচারণা ও উদ্ভবপ্রচেষ্টা মুসলমানদের চিন্তার উপর আঘাত হেনেছিল। অমুসলিম শাসনামলে কোনো ইসলাম বিরোধী আন্দোলন ও মুসলিম শাসনামলে ইসলাম বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে ফারাক আছে। অমুসলিম শাসনামলে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বললে মুসলমানরা সামগ্রিকভাবে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং এর ফলে তাদের চিন্তাধারার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। কিন্তু মুসলিম শাসনামলে কোনো ইসলাম বিরোধী প্রচারণা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে। বিশেষ করে শাসকদের পক্ষ থেকে হলে তা হয় অনেক বেশি ক্ষতিকর। আকবরের পরে শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোহ সর্বধর্ম সমন্বয়ের যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা চালান মুসলিম সমাজে তার প্রভাব আওরঙ্গজেব নিজেই অনুভব করেছিলেন। এসব কারণে তিনি একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের তাগিদ অনুভব করেন।

অন্তত সমকালীন ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ারের বক্তব্য থেকে তাই অনুমান করা যায়। বার্নিয়ার তার ভ্রমণ কাহিনির এক জায়গায় আওরঙ্গজেবের একজন শিক্ষকের প্রসঙ্গ

উত্থাপন করেছেন। এই শিক্ষক মহোদয়কে বাদশাহ অত্যন্ত সম্মান করতেন। কোনো কারণে এই শিক্ষক বাদশাহর দরবারের প্রথম শ্রেণির উমারাদের অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য তদবির করতে থাকেন। এ কথা জানতে পেরে আওরঙ্গজেবের শিক্ষককে ডেকে এনে বলেন- জনাব আমি জানতে পেরেছি আপনি দরবারে উচ্চ পদ লাভের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আপনি মনে করছেন আমার শিক্ষক হিসেবে আমার উপর আপনার অধিকার আছে, কাজেই এ পদ আমি আপনাকে দিয়ে দেবো। কিন্তু আপনি যদি আমাকে সত্যিকার কোনো কার্যকরী শিক্ষা দিতেন তাহলে হয়তো এ অধিকার আপনার হতো। আপনি আমাকে কী শিখিয়েছেন? আপনি শিখিয়েছেন, ইংল্যান্ড একটা সাধারণ পর্যায়ের দ্বীপমা… ফ্রান্স ও স্পেনের বাদশাহদের সম্পর্কে আপনি আমাকে জানিয়েছেন যে, তারা আমাদের দেশের সাধারণ রাজাদের মতো এবং হিন্দুস্থানের শাহানশাহ তাদের থেকে অনেক বড়….আপনি আমাকে জানিয়েছেন যে, ইরান, কাশগড়া, তাতার, পেস্ত (মায়ানমার), শ্যাম (থাইল্যান্ড) ও চীনের শাসকরা হিন্দুস্থানের বাদশাহর নাম শুনে কেঁপে ওঠে। সুবহানাল্লাহু, আপনার ভূগোল ও ইতিহাস জ্ঞানের প্রশংসা কীভাবে করবো? আপনার কর্তব্য কী ছিল? আপনার কর্তব্য ছিল দুনিয়ার জাতিদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী আমাকে জানানো। আমাকে জানাতেন বিভিন্ন দেশের উৎপন্ন দ্রব্যাদি, তাদের সামরিক শক্তি, যুদ্ধরীতি ও সমগ্র কৌশল, তাদের সামাজিক রীতি-রেওয়াজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি ও কূটনীতি। আপনার উচিত ছিল আমাকে ইতিহাসের শিক্ষা দেয়া। কীভাবে একটি সরকারের সূচনা হয় এবং তার উন্নতি ও পতনের কারণগুলো কী? যেসব কারণে বড় বড় বিপ্লব সাধিত হয় সেগুলো সম্পর্কে আমাকে অবহিত করা উচিত ছিল।

বার্নিয়ারের এ বক্তব্য শায়খ মুহাম্মদ আকরাম তার ‘মউজে কাওসার’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি এবং তার মতো আরো অনেকেই

বার্নিয়ারকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই আওরঙ্গজেবের প্রসঙ্গে বার্নিয়ারের এ বক্তব্যও তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের গৃহীত শিক্ষানীতি থেকে বার্নিয়ারের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়।

কয়েকশ বছর থেকে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় আলমগীর যে সংস্কার সাধন করেন তা শুরু হয় তাঁর একটি সংশোধনী ফরমানের মাধ্যমে। তিনি যখন শুনলেন কোনো কোনো শাহজাদা তাদের দরবারে গণক জ্যোতিষীদেরকে সংশ্লিষ্ট করেছেন এবং তাদের গণনার ভিত্তিতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কাজ সম্পাদন করে থাকেন, তখন তিনি ফরমানটি জারি করে সকল প্রদেশে এ ধরনের কাজ একমদ বন্ধ করে দিলেন। গণক ও জ্যোতিষীদের এ শরিয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য মুচলেকা দিলেন।

‘মাসিরে আলমগীরি’র বর্ণনা মতে- বাদশাহ যখন জানতে পারলেন মুলতান ও বোরস প্রদেশে অনেক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দেবার জন্য টোল খুলেছেন, হিন্দুদের সাথে সাথে অনেক মুসলমান ছাত্রও সেখানে ভর্তি হয়েছে এবং তারা মিথ্যাশিক্ষা লাভ করছে। তখন এক হুকুমনামা জারি করে এ শিক্ষায়তনগুলো বন্ধ করার জন্য ফরমান জারি করলেন। এরপর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুবিন্যস্ত করার জন্য তিনি একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। লক্ষ্মৌয়ের ফিরিঙ্গি মহলের আলেমদের নেতৃত্বাধীনে এ শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়।

মাওলানা আব্দুল হালীম শারার তার ‘লক্ষ্মৌয়ের ইতিকথা’ গ্রন্থে ফিরিংঙ্গি মহলের একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। এ বর্ণনা থেকে জানা যায়, একজন ফরাসি ব্যবসায়ী মোঘল বাদশাহ আকবরের শাসনামলে এখানে একটি বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণ করেন। এ অট্টালিকা চারটি বিশাল দেওয়ানখানায় বিভক্ত ছিল। ফরাসি ব্যবসায়ী সাময়িক অবস্থানের অনুমতিপত্র লাভ করেছিলেন। প্রতি বছর এ অনুমতিপত্র নবায়ন করে তাকে এখানে অবস্থান করতে হতো। এক বছর তিনি ভিসা নবায়ন করতে পারেননি। তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। ফলে এ মহল সরকারের অধিকারভুক্ত হয়।

আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে এ মহলটি শায়খ কুতুবুদ্দীন শহীদ শাহালভীর পরিবারকে দান করেন। শায়খের সন্তানদের মধ্যে মোল্লা নিজাম উদ্দীন বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। এই মোল্লা নিজাম উদ্দীন ছিলেন আলমগীরের শিক্ষা কমিশনের সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান। তার নামেই এই সিলেবাস ‘দরসে নিজামী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। মোল্লা নিজাম উদ্দিন নিছক একজন শিক্ষক ছিলেন না। বরং তিনি ফিরিঙ্গি শহরকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পৌনে তিনশ বছর শিক্ষাক্ষেত্রে উপমহাদেশের মুসলমানদের বিরাট খেদমত করে। আঠার শতকের উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য দীনি ও জাগতিক জ্ঞানের একটি উত্তম সমন্বিত রূপ ছিল এ ‘দরসে নিজামী’। পরবর্তীকালে এ সিলেবাসে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়।

উনিশ শতকের উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলে দারুল উলুম দেওবন্দের মাধ্যমে দারসে নিজামী নামে যে সিলেবাসটি চালু হয়, সেটি এর একটি কর্তিত রূপ। আওরঙ্গবেজ দেওয়ানে হাফেজ ও মুজাদ্দিদে আলফেসানির মাকতুবাতের প্রচার সীমিত করে দেন এবং এগুলোর ব্যাপক প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি নিজে দেওয়ানে হাফেজ ও মাকতুবাতের আগ্রহী পাঠক ছিলেন। এক্ষেত্রে তার এই নিষেধাজ্ঞার কারণ সম্ভবত এটাই হতে পারে যে, দেওয়ানে হাফেজ সাধারণ পাঠকদের মধ্যে বেআমলি সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে মাকতুবাত হচ্ছে মুজাদ্দিদ সাহেবের পত্রাবলির সমষ্টি। এ পত্রাবলি যাদের কাছে লেখা হয়েছিল, তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক গঠনের সাথেই ছিল এগুলোর সম্পর্ক। প্রথম বিশটি পত্র ছিল হযরত মুজাদ্দিদে নিজের মুরশিদের নামে। সেগুলোতে অনেক বিশেষ আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কাজেই নিশ্চিতভাবে তা সাধারণ্যে প্রচারের উপযোগী নয়। তাছাড়া তার চিন্তাধারার মধ্যে শিয়া ও হিন্দুদের ব্যাপারে যে অতি কঠোরতা দেখা যায়, তাও যে কোনো রাষ্ট্র ও সরকারের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং এর ফলে জনজীবনে শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা থাকে।

শিক্ষকদের অর্থনৈতিক জীবনকে সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ করেন। শিক্ষকদের সম্পর্কে মুহাম্মদ সাফী মুসতাআস খান লিখেছেন, প্রদেশগুলোর সমগ্র মসজিদ মেরামত করা ছাড়াও মুয়ায্যিন ও খতিবগণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিযুক্তি লাভ করতেন। সরকারি কোষাগার থেকে তাদের বেতন দেয়া হতো। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও এ নিয়ম চালু করা হয়। প্রত্যেক শহর ও মফস্বল এলাকায় ছোট বড় সমস্ত মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন সরকারি কোষাগার থেকে দেয়া হতো এবং ছাত্ররাও সরকারি ভাতা লাভ করতো। অর্থাৎ সমগ্র জাতীয় শিক্ষাই ছিল অবৈতনিক। ইংরেজরা যখন বাংলা দখল করে, তখন এই একটি মাত্র প্রদেশেই ছিল দুই লাখ প্রাইমারি স্কুল। কোনো কোনো ছাত্র প্রতিদিন দুই টাকা করে ভাতা পেতো।’

প্রত্যেক জেলার কোতোয়াল ও শাসনকর্তা অর্থাৎ এসপি ও ডিসির প্রতি সরকারি নির্দেশ ছিল যে, সময় বের করে তাদের নিজেদের ও ছাত্রদের অধ্যাপনার কাজে কিছুটা অংশগ্রহণ করতে হবে। এর ফলে ছাত্ররা বাস্তবজ্ঞান লাভ করতে পারবে, তাদের মানসিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কোতোয়াল ও জেলা প্রশাসক স্থানীয় কাজির সহায়তায় সরকারকে ছাত্রদের সম্পর্কে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাবেন। যেখানেই প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যেতো, তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা হতো। আওরঙ্গজেব প্রত্যেক প্রদেশের জন্য এ ব্যবস্থা করেন। অনুমান করা যেতে

পারে এ জন্য কত বড় সেক্রেটারিয়েটের প্রয়োজন ছিল।

দুই

সময়ের প্রয়োজনে মহাপরাক্রমাশীল বীর মোঘলদেরকেও একদিন বিদায় নিতে হয়েছে এই ভারতবর্ষ থেকে। যে পথে এসেছিলেন মহাবীর বাবর, সে পথেই ধূর্ত ইংরেজরা ভারত থেকে বের করে দেয়, তাড়িয়ে দেয়, ভারত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে। নির্বাসনে পাঠায় বার্মার রেঙ্গুনে। কবরের জন্য সাড়ে তিনহাত মাটি মিলেনি ভারত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের। বার্মায় চিরনিন্দ্রায় শায়িত হন ভারতের মহান মোঘল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ্ জাফর।

ভারতবর্ষে মোঘলদের আগমন ঘটেছিল বীরের বেশে। ভারতের শেষ মোঘল সম্রাটকে প্রস্থান করতে হয়েছে করুণভাবে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে, বন্দি বেশে। ভারতবর্ষ থেকে ভারত সম্রাট বাহাদুরশাহ্ জাফরের প্রস্থান হলেও মোঘল সাম্রাজ্যে পতনের সাথে সাথে এই উপমহাদেশ থেকে মোঘল সভ্যতা-মোঘলাই সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বরং বাবর থেকে বাহাদুর শাহ্ পর্যন্ত ভারতের মোঘল সম্রাটগণ ভারতবর্ষের সভ্যতা-কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে যে অবদান রেখে গেছেন তা ‘মোঘলাই ঐতিহ্য’ হিসেবে অটুট থাকবে চিরকাল। এই উপমহাদেশে এখনও মোঘলাইখানা-মোঘল সংস্কৃতির লোকপ্রিয়তা ও দাপট বিদ্যমান।

ভাল শিক্ষাদানের জন্য রয়েছে অনেকগুলো পূর্বশর্ত। এসব শর্ত পূরণ না করে ভাল শিক্ষার জন্য যতই চিৎকার করা হোক না কেন তাতে কোন লাভ নেই। যেমন ভাল শিক্ষার জন্য চাই ভাল ছাত্র, উন্নত শিক্ষার পরিবেশ, মানসম্পন্ন ও সুবিন্যস্ত পাঠ্যক্রম, উন্নত ও আধুনিক বইপত্রসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ এবং দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন। কিন্তু আমার ধারণা এই সব কিছুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ উপাদান হলো আদর্শ শিক্ষক। কিন্তু যে সমাজে তদবির করে কিংবা ঘুষ প্রদান করে একজন শিক্ষক নিয়োগ লাভ করেন তাতে কী করে আর আদর্শ শিক্ষক বলা যায়?

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পটি ছিল খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৯৩ সালে প্রকল্পটির যাত্রা শুরু করে। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ৩ বছর। ১৯৯৬ সালে প্রকল্পটি ২য় পর্যায়ে ৫ বছরের জন্য অনুমোদিত হয় এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত এর কার্যকাল স্থায়ী ছিল। ১ জানুয়ারি ২০০১ থেকে প্রকল্পটি পুনরায় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং ৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে প্রকল্পটি ৩য় পর্যায় শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির ৪র্থ পর্যায়ের জন্য পুনরায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পেশ করা হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২২ জানুয়ারি ২০০৬

তারিখে প্রকল্পটি পিইসি সভায় অনুমোদিত হয়। পিইসি সভার পর ১৮৭৬৬টি মসজিদে কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়। ১ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের দ্বারা এই প্রকল্পের কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয়।

শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫৬ হাজার ইমামকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণ মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৫০ লাখ শিশুকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন।

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে ৪র্থ পর্যায়ে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তির হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারাদেশে ১৮ হাজার শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৬ লাখ ২০ হাজার শিশু শিক্ষার্থীকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা (প্রতি কেন্দ্রে ৩০ জন ছাত্র)।

বয়স্কস্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাক্ষরতা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা (প্রতি কেন্দ্রে ২৫ জন বয়স্ক শিক্ষার্থী)। সারাদেশে ১২ হাজার শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ১২ লাখ ৬০ হাজার জন স্কুলগামী শিক্ষার্থীকে পবিত্র কোরআন শরিফ শিক্ষাদান করা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ৪৭৪টি রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা।

২৮ মার্চ ২০০৬ তারিখে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর এক পর্যালোচনা সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ‘মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৪র্থ) পর্যায় প্রকল্পটি সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে পরবর্তী অর্থবছরে পর্যায়ক্রমে বিবেচনা করা যেতে পারে।

বিএনপি সরকার সংসদ নির্বাচনি বিভিন্ন সভায় মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প আরো সম্প্রসারিত ও জনকল্যাণমূলক করার ওয়াদা করেছিল।

শিশু বয়সেই আমাদের ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় ও নীতি আদর্শ শিক্ষা দেয়া জরুরি। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষের মাঝে সামাজিক অপরাধ দিনদিন বাড়ার পাশাপাশি, শিশু কিশোরদের মাঝেও অপরাধের দাপট ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘটমান কিশোর অপরাধ-অপরাধীর আচরণ দেখে এটা থেকে আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। শিশু-কিশোরদের অপরাধ তৎপরতা অনেক ক্ষেত্রে ইয়াং অপরাধীদের কর্মকা-কেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অনগ্রসর শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও গণশিক্ষার সম্প্রসারণ এ সমস্যা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।

হারানো ঐতিহ্যের মক্তব নয় প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় :

মক্তব নিয়ে শঙ্কা : গ্রামের মসজিদের ইমাম মাওলানা হোজায়ফা ফজরের নামাজের পর মাইকে এলান দিলেনÑ ‘এলাকার মা ও বোনেরা! আপনাদের সন্তানদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তাড়াতাড়ি মক্তবে পাঠিয়ে দেন।’ এলান দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করে পড়ানোর নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তার শিক্ষার্থীরা মক্তবে আসতে শুরু করলো। আধাঘণ্টা সময় নিয়ে তার সমস্ত শিক্ষার্থী মসজিদের মক্তবে এলো। আর কারও আসার সম্ভাবনা নেই। ইমাম সাহেব হতাশ হয়ে তার শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাদের সংখ্যা সাকুল্যে ৭ জন! প্রতিদিন এই হার এমনই থাকে প্রায়!!

কিন্তু একটা সময় মক্তবের এই হাল ছিল না। মাওলানা হোজায়ফা যখন ছোট ছিলেন, মক্তবের শিক্ষার্থী ছিলেন তখন তিনি দেখতেন, প্রতি সকালে মক্তবের শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠতো মসজিদের বারান্দা। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ছেলেমেয়েদের ভোরবেলা মক্তবে আসা ছিল বাধ্যতামূলক। পাঁচ বছর থেকে শুরু করে বারো-পনেরো বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা কায়দা আমপারা আর কুরআনের তালিম নিতো গ্রাম-মহল্লার মক্তবে। একদম তিন-চার বছর বয়সী ছেলেমেয়েদেরও তাদের মায়েরা কোলে করে মক্তবে দিয়ে যেতো।

সেই দৃশ্য এখন আর ততোটা সহজসাধ্য নয় বাংলাদেশে। শহরকেন্দ্রিক জীবনধারায় তো নয়ই, গ্রামীণ সমাজেও মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা নির্জীব হয়ে পড়েছে। নাগরিক বিভিন্ন ধরনের ব্যস্ততা আর শিশুশিক্ষার বহুমুখিতার ফলে মক্তবের প্রয়োজনীয়তা আমাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। মসজিদভিত্তিক এ মক্তব শিক্ষাধারাটি আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, এ কারণে এর ফলাফলটা আমাদের সমাজে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মক্তবের প্রতি মানুষের আগ্রহ যে হারে কমছে, তার পরিমাণ ভয়াবহরকম। গ্রামে এই হার ধীরে হলেও শহরে এই হার মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। শহরের অনেক মসজিদেই এখন আর সকালবেলা মক্তবের শিশুদের আলিফ-বা-তা’র গুঞ্জন শোনা যায় না।

মক্তব নিয়ে কেন হা-হুতাশ
মক্তব কেবল একটি ধর্মীয় শিক্ষার প্রাথমিক স্তর নয় বরং এখান থেকেই প্রতিটি মুসলিমশিশু পরবর্তী জীবন গঠনের অনেক আবশ্যিক নৈতিকতা শিক্ষা নেয়। একটি শিশুর শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক গুণাবলীয় উন্নয়নই এ শিক্ষার উদ্দেশ্য। মক্তব সেই শিক্ষারই গোড়াপত্তন করে শিশুমনে। কিন্তু আমাদের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় আদর্শ

ও নৈতিক দিকটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আমরা প্রতিনিয়ত তার মারাত্মক পরিণতি চোখের সামনেই দেখছি।

প্রতিটি মুসলমান শিশুর অন্তরে ধর্মের প্রতি ভালবাসা এবং জীবনে ধর্মপালনে আবশ্যিক ধর্মীয় শিক্ষা এই মক্তবেই দেয়া হয়ে থাকে। কোনো শিশু যদি শৈশবে ধর্মের এসব ফরজ বিষয় শিখে নিতে পারে তাহলে তার পরবর্তী জীবনে এর প্রতিফলন ঘটে ব্যাপকভাবে। নামাজ-রোজা-জাকাতসহ ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলোর ভিত্তি এখানে শেখানো হয়। যা পরবর্তী জীবনে শেখাটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

অনেক শিক্ষিত এবং আধুনিক বাবা-মা বাসায় আরবি শিক্ষক রেখে বাচ্চাদের কুরআন এবং ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং এ ধরনের শিক্ষার দ্বারা শিশুদের মানসিক বিকাশ সেভাবে গড়ে ওঠে না। বাসায় আরবি শিক্ষক রেখে কুরআন শিখলে কেবল আরবিতে কুরআন শিক্ষাটাই পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মক্তব কেবল কুরআন শিক্ষার মাধ্যম নয়। মক্তব আমাদের সমাজের একটি গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। এখানে ¯্রষ্টার উপর শিশুর বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপিত হয়। নবি ও সাহাবিদের গল্প, পির-দরবেশ ও আউলিয়াদের কাহিনী, ধর্মীয় বিভিন্ন দিবসের উপকারিতা, মানবজীবনে ধর্মীয় আমলের প্রয়োজনীয়তা, জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা ইত্যাদির বর্ণনা শিশুর কোমল মনে খুব ভালভাবে গেঁথে দেয়া হয় এসব মক্তবে। যেগুলো পরবর্তী জীবনের চলার পথে একজন শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক পথনির্দেশ করে। এই সামষ্টিক শিক্ষা বাসা-বাড়িতে শিক্ষক রেখে পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়।

কেন হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব
মক্তব কেন হারিয়ে যাচ্ছে সে প্রশ্নের উত্তর এক কথায় কিংবা একটি কারণ উদ্ঘাটনের মাধ্যমে সমাধান দেয়া যাবে না। এর কারণ অনেক। বর্তমান সময়ে গ্রামাঞ্চলে দু’ একটি মসজিদে মক্তব থাকলেও শহরের বেলায় তা শূন্যের কোটায়। দেশে প্রতি বছর অসংখ্য নতুন নতুন মসজিদ স্থাপন হলেও সে হারে মক্তব বাড়ছে না। বরং যেসব মসজিদে মক্তব চালু আছে সেগুলো বন্ধ হচ্ছে দিনকে দিন। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে মক্তবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। থাকবে না কুরআন শেখার এ সহজ সুযোগ। আমরা প্রাথমিকভাবে মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যাবার কয়েকটি কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছি।

* প্রথম কারণ হলো, বর্তমানে কিন্ডার গার্টেন, কোচিং, প্রভাতী স্কুল, ডে-কেয়ারসহ আরও নিত্যনতুন আধুনিক শিক্ষাধারার প্রভাতী ক্লাস মক্তবের শিক্ষাকে সবচে বেশি আঘাত করেছে। সেই সঙ্গে শিশুদেরকে ছোটবয়সেই অধিক লেখাপড়া শেখানোর মহান (!) ব্রতে প্রলুব্ধ হয়ে মা-বাবারা সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেন অত্যধিক চাপ। সেই চাপে পড়ে একটি কোমলমতি শিক্ষার্থীর মক্তবে যাওয়ার সময়টাই কোথায়? এখন ভোর হলেই দেখা যায়, আধুনিক মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে তড়িঘড়ি করে স্কুলের দিকে রওনা দিচ্ছেন। ভোরবেলা সন্তানকে ঘুম থেকে জাগিয়েই তাদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় সন্তানকে কিন্ডার গার্টেন বা প্রভাতী স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে। সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে, তাকে মক্তবে পাঠাতে হবে- এমন চিন্তাই অনেক মায়ের মনের মধ্যে আসে না। তারা সন্তানকে যন্ত্রের মতো একটি মানবযন্ত্র বানিয়ে ফেলেন। যার কাজ হলো, ব্যাগভর্তি বই নিয়ে সকাল সকাল স্কুলে যাওয়া এবং দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞানে বিদ্বান হওয়া। যাতে করে পার্থিব জীবনের প্রতিযোগিতায় সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে। পরকালের চিন্তা তাদের খুব একটা ভাবিত করে না।

এগুলো ছাড়াও কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, বিতর্কের ক্লাসসহ আরও নানা ক্লাস করতে করতে একজন শিশুর পক্ষে মক্তবে যাওয়ার মতো সুযোগই থাকে না। আড়ালে পড়ে যায় তার ধর্মীয় শিক্ষার আবশ্যিকতা। এ কারণেই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর দিকে তাকালে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এদের প্রায় আশি শতাংশ শিক্ষার্থীই কুরআন তেলাওয়াত করতে জানে না। জানে না প্রয়োজনীয় অনেক মাসয়ালা ও মাসায়েল। আবার ছোটবয়সে নৈতিক শিক্ষার অধ্যয়ন না পাওয়ার ফলে এরা অনৈতিকতার পথে পা বাড়ায় খুব সহজেই। হয়তো এমন অনেক পরিবারও আছে যারা তাদের সন্তানদের মক্তবে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ধর্মশিক্ষা দিতে চান। কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার

অতি আগ্রহের যাঁতাকলে পড়ে তারা তাদের সন্তানকে সে শিক্ষা দিতে পারেন না।

মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যাবার আরেকটি মূল কারণ হলো, মানুষের মধ্যে ধর্ম এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া। এটা সামাজিকভাবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। মানুষ ইসলামের অনুশাসন না মানার ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিও তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। মানুষ এখন কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। নিজেকে সমাজের অনেক উঁচুতে নিতে বদ্ধপরিকর। সেই উচ্চাভিলাষের পথে ধর্ম তাদের খুব একটা সাহায্য করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে ইসলাম তাদের এই অবৈধ উচ্চাভিলাষের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে আধুনিক মানুষের মনে ধর্ম এবং ধর্মীয় শিক্ষাটা খুব একটা প্রয়োজনীয় হয়ে বিবেচিত হয় না।

টিভি-ডিশ কালচারও অনেকভাবে মক্তব শিক্ষাকে হারিয়ে যেতে প্রভাবিত করছে। অনেক পরিবারে বাচ্চারা অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দেখে। ফলে সকালে ঘুম থেকে তারা দেরিতে ওঠে এবং মক্তবে যেতে কোনো ধরনের আগ্রহ বোধ করে না। তাছাড়া টিভি দেখার ফলে ছোট বাচ্চাদের মনে ধর্মের প্রতি বিরূপ প্রভাব পড়ে। তারা মক্তবে হুজুরের কাছে শুনে আসছে ইসলামের নান্দনিকতা কিন্তু তার পরিবারে এবং টিভিতে সে নান্দনিকতা ও মনোরঞ্জনের উপাদান পাচ্ছে অন্যপন্থায়। এভাবে তার মনের মধ্যে ধর্ম এবং বাস্তব জীবন নিয়ে অনেকটা দ্বন্দ্বমুখরতা সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবেই তার কোমল মনে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়। আবার পরিবারের মধ্যেও ডিশ-কালচারের কুপ্রভাব তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তাদেরকে ভিন্ন সংস্কৃতির আসক্ত করে ফেলে। অধিক টিভি দেখার কারণে ছোট বাচ্চারাও এখন শিশুবয়সেই হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলে খুব সহজেই। অথচ কুরআন শিক্ষার জন্য তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা হয় না।

মিডিয়ায় ধর্মীয় শিক্ষা এবং মাদরাসা নিয়ে নেতিবাচক এবং ঘৃণামূলক বিষয় প্রচারের ফলেও মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি মিডিয়া তো বটেই আমাদের দেশীয় মিডিয়াও ধর্মীয় শিক্ষাকে আধুনিকতা এবং প্রগতির চরম অন্তরায় বলতে মোটেও কসুর করে না। আবার অনেকে এটাকে জঙ্গিবাদের আঁতুড়ঘর বলেও মন্তব্য করেন। তাছাড়া সমাজের উচ্চশ্রেণি ধর্মীয় শিক্ষাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে প্রতিনিয়ত। ধর্মীয় শিক্ষার মূলভিত্তি মক্তবের উপর ধর্মহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত মিডিয়ার আঘাত সর্বদাই আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে। সিনেমা, নাটক, খবর, ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপন সব জায়গায় ধর্মীয় শিক্ষাকে হেয় করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো। এসব কারণে সাধারণ মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা তথা মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

মিশনারি এবং এনজিও কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শিক্ষাদান মক্তব হারিয়ে যাবার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন অনেকে। বিশেষত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, চরাঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চলে এই প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। খ্রিস্টান মিশনারি এবং এনজিওরা নানামুখী শিক্ষা কার্যক্রমে শিশুদের সম্পৃক্ত করে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি তাদের বীতশ্রদ্ধ করে তোলেন।

সরকারি কোনো ধরনের সহযোগিতা না থাকাও মক্তব বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন মক্তব নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন গবেষক। যেহেতু মক্তবকেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষাটি সম্পূর্ণ অবৈতনিক একটি কার্যক্রম, এ কারণে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন বা শিক্ষকরাও এ ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে জানা গেছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত মসজিদভিত্তিক মক্তব কার্যক্রম অনেকটা স্থবির করে রাখা হয়েছে। এ সরকারি প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে কোনো মক্তবও প্রতিষ্ঠা করছে না। এমনকি ফাউন্ডেশন বিগত দিন ধরে চলে আসা অনেক মক্তবকেও আর নিয়মিত তদারকি করছে না। ফলে ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত শত শত মক্তব বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ফাউন্ডেশন মসজিদভিত্তিক পাঠাগার কর্মসূচিও বন্ধ রেখেছে বলে আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে।

তবুও আশার আলো
এতোকিছুর পরও আশার আলো একদম নিভে যায়নি। এখনও নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে অনেক আশার প্রদীপ। আবার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে ওঠছে নতুন নতুন শিক্ষাধারা। সব সমস্যা মাথায় রেখে ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক উদ্যোগে সারাদেশে গড়ে ওঠেছে মক্তবের আদলে অনেক প্রতিষ্ঠান। এমনই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘দারুল আরকাম ইনস্টিটিউট’। কয়েকজন প্ররিশ্রমী আধুনিক তরুণ আলেমের হাত ধরে গড়ে ওঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তারা তাদের ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ৬টি ব্যাচে শিশুদের কুরআন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে। যাতে করে যে শিশু যখন স্কুলের ক্লাস করার পর সময় পাবে তখনই যেনো সে কুরআন শেখার জন্য ইনস্টিটিউটে আসতে পারে।

তাদের এই উদ্যোগে সাড়াও পড়েছে বেশ ভালো। এ ব্যাপারে আমরা কথা বলি ইনস্টিটিউটের পরিচালক হাফেজ মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম রিয়াদের সঙ্গে। তিনি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বলেন, ‘পুরনো মসজিদকেন্দ্রিক মক্তবব্যবস্থা অনেকটা নিশ্চল হয়ে যাওয়ায় আমরা চিন্তা করলাম, কেন মানুষ মক্তবে আসছে না। আমরা বুঝতে পারলাম, আধুনিক সমাজব্যবস্থা মানুষকে অনেক বেশি ব্যস্ত করে ফেলেছে। তাদের সন্তানদেরকেও তারা

সেভাবেই গড়ে তুলতে আগ্রহী। সেই প্রেক্ষিতে আমরা আধুনিক ব্যস্ত মানুষের জন্য তাদের চাহিদানুযায়ী এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা ভাবলাম, যেটি সারা দিনব্যাপী চালু থাকবে এবং আগ্রহী শিক্ষার্থী যখন সময় দিতে পারে তখনই তাকে কুরআন শিক্ষার শিক্ষার্থী হিসেবে গ্রহণ করবো।’

আপনাদের এই নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা কাইয়ুম বলেন, ‘আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। প্রতিষ্ঠার চার বছরের মধ্যে মানুষের আগ্রহের কারণে আমাদের চারটি শাখা খুলতে হয়েছে। সেসব শাখায়ও আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চমৎকারভাবে চলছে। আমাদের দেখাদেখি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রণীত শিক্ষার ধারাটি অনুসরণ করে সারাদেশে অসংখ্য মক্তব গড়ে তুলছে।’

এই কার্যক্রম দিয়ে কতোটা সাফল্য আশা করা যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু এখনও যথেষ্ট ধর্মভীরু। অনেকেই তাদের সন্তানদের ইসলামি শিক্ষা দিতে চান কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ফলে তারা তা দিতে সক্ষম হন না। আমাদের শিক্ষাক্রমটি যেহেতু অভিনব এবং এই বিষয়টি চিন্তা করেই সাজানো হয়েছে তাই তারা খুব সহজেই দৈনিক মাত্র এক ঘণ্টা সময় দিয়ে শুদ্ধভাবে কুরআন পাঠসহ ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে।’

তবে মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম তাদের প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বাস্তবিকভাবে সারাদেশের চিত্র একরকম নয়। আর তাছাড়া তাদের প্রণীত এই আধুনিক শিক্ষাক্রমটিও এখনো দেশের বৃহৎ মক্তব শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সারাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম-মহল্লার মসজিদকেন্দ্রিক সাধারণ মক্তব ছাড়াও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন শত শত মক্তব পরিচালনা করে থাকে। যেমন বাংলাদেশ কোরআন শিক্ষা বোর্ড, নূরানী তা’লীমুল কুরআন, নূরানী তা’লীমুল কুরআন (ওয়াক্বফ) এস্টেট, নাদিয়াতুল কুরআন ফাউন্ডেশন, খুদ্দামুল কুরআন, মসজিদ মিশন বাংলাদেশ। এছাড়াও বড় বড় মাদরাসা ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে অনেক মক্তব পরিচালনা হয়ে থাকে।

নোয়াখালী অঞ্চলে তিনশ’র অধিক মক্তব পরিচালনা করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ (ছদ্মনাম) নামের তাবলিগ জামাতের এক মুরব্বি। তিনি এবং তার কয়েকজন পরিচিতজন নিঃস্বার্থভাবে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনো ধরনের প্রচারণা ব্যতিরেকে তারা নিভৃতে এই শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের অন্তরে গেঁথে দিচ্ছেন কুরআনের আলিফ-বা-তা। এই প্রতিবেদক তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তার বা অন্যকোনো পরিচালকের নাম-পরিচয় গোপন রাখতে অনুরোধ করেন।

মাওলানা বখতিয়ার হোসেন নামের একজন

চরাঞ্চল এবং প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে মিশনারি ও এনজিওদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী শিক্ষাকে প্রতিহত করতে অসংখ্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা’র বিজ্ঞানী ড. আব্দুল আউয়ালও একইভাবে নিভৃতে পরিচালনা করে চলেছেন অসংখ্য মক্তব। উত্তরবঙ্গে বগুড়ার জামিল মাদরাসার অধীনে চলে প্রায় হাজারের ওপর মক্তব ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

এভাবেই দেশব্যাপী অনিয়মতান্ত্রিক এবং বিচ্ছিন্নভাবে মক্তব নিয়ে অনেক কাজ হলেও এখন পর্যন্ত তা অপ্রতুল। তাছাড়া শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকার কারণে এই উদ্যোগগুলোও প্রশাসন বা বিভিন্ন মিডিয়ার অপপ্রচারের মুখে পড়েছে। খুদ্দামুল কুরআন নামে একটি মুসলিম এনজিও গুচ্ছগ্রামভিত্তিক মক্তব পরিচালনা করতো। সারাদেশের গুচ্ছগ্রামগুলোতে তারা মক্তব প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার নি¤œবিত্তের ছেলেমেয়েদের প্রায় বিনামূল্যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করতো। এতে তারা ব্যাপাক সাড়া পায়। কিন্তু একশ্রেণির বিদেশি মদদপুষ্ট এনজিও প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া কিছুদিন পর প্রচার শুরু করেÑ ওই মক্তবগুলো জিহাদের ট্রেনিং সেন্টার। পত্রিকায় খবর বেরুলোÑ খুদ্দামুল কুরআনের পাঁচশ’ ট্রেনিং সেন্টারে তালেবানি প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এভাবে ওই সংস্থাটির ওপর সরকারের রোষদৃষ্টি পড়ে এবং খুব সহজেই গুচ্ছগ্রামভিত্তিক মক্তবগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এরকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করে তাদের কার্যক্রমকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

শেষকথা, সম্ভাবনার কথা

এসব পরস্পরমুখী সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিচার করে ধর্মীয় মহল ও শিক্ষাবিদদের উচিত শিশুদের উপযোগী করে কুরআন ও ইসলাম শিক্ষাকে জাতির সামনে পেশ করা। যাতে করে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও প্রতিটি শিশু পেতে পারে। যার অভাব আমাদের সমাজে সবচে বেশি লক্ষ্য করা যায়।

বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে বলা যায়- প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন যে ‘ইসলাম শিক্ষা’ পাঠদান করা হয় সেই বিষয়টি আরেকটু কুরআনমুখী করে নতুন করে বিন্যাস করা যেতে পারে। যাতে করে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ শেষ করে একজন শিক্ষার্থী কুরআন শুদ্ধভাবে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় দীনিয়াতও শিক্ষা করতে পারে। তাহলে উভয় শিক্ষার মধ্যেই সমন্বয় সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ। এতে করে যারা সকালবেলা স্কুলে আসার কারণে মক্তবে পড়তে যেতে পারে না তাদের কুরআন শিক্ষার জন্য আর আলাদা কোনো শিক্ষার প্রয়োজন পড়বে না। এভাবেই উভয় শিক্ষাকে একীভূত করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

 

সূত্র: https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/Mirzarif/29976999 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *